আইনস্টাইন আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের সাহায্যে একটি বিখ্যাত সম্পর্ক বের করেন। এটি হলো ভর ও শক্তির সম্পর্ক। ভরকে শক্তিতে রূপান্তরের সম্পর্ক নিম্নোক্তভাবে লেখা যায়,
E = mc2
যেখানে, E = মোট শক্তি
m= বস্তুর ভর এবং
c = আলোর দ্রুতি
গতিশীল অবস্থায় বস্তুর ভর বৃদ্ধি পায় এই তথ্য ব্যবহার করে কোনো বস্তুর। গতিশক্তি নির্ণয় করলে দেখা যায় যে, ভরকে শক্তিতে রূপান্তর করলে প্রচুর শক্তি পাওয়া সম্ভব। এই বিষয়ে | একটি প্রতিবেদন তৈরি কর।
সংকেত : আমরা জানি যে, কোনো বস্তুকে নিশ্চল অবস্থা থেকে গতিশীল অবস্থায় আনতে যে পরিমাণ কাজ করতে হয় তাকে বস্তুর গতিশক্তি বলে। অর্থাৎ
বস্তুর গতিশক্তি = গতিশীল হতে বস্তু দ্বারা সম্পাদিত কাজ।
ধরা যাক, বস্তুটিকে গতিশীল করতে F বল প্রয়োগ করা হলো এবং বস্তুটি বলের দিকে ds পরিমাণ দূরত্ব গেল।
সুতরাং গতিশক্তি = Fds
বস্তুটি মোট দূরত্ব S হলে
মোট গতিশক্তি,
আমরা জানি যে,
ভরের আপেক্ষিকতা থেকে আমরা জানি যে,
এখন F ও ds এর মান বসিয়ে,
এই সমীকরণটি বর্গ করে পাওয়া যায়,
বা, (1 - v2/c2)m2 = m2o
বা, m²c2 - m²y2 = m2oc2
এই সমীকরণকে অন্তরীকরণ করে পাওয়া যায় যে,
2mc2dm - (2mv2dm + 2vm2dv) = 0
উপরোক্ত সমীকরণকে 2m দ্বারা ভাগ করে পাওয়া যায়,
c2dm-v2dm = mvdv
বা, mvdv + v2dm = c2dm
এই মান ( 8.38) সমীকরণে বসালে,
এখানে mo হলো নিশ্চল ভর।
কিন্তু মোট শক্তি, E = T + moc2 = গতিশক্তি + নিশ্চল শক্তি
:- E = mc2
এই সমীকরণটি আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের অন্যতম ফসল যা হলো ভর শক্তির একটি রূপ। আবার শক্তির ও ভর রয়েছে বা শক্তিও ভরের একটি রূপ। ভরকে শক্তিতে রূপান্তর তেজস্ক্রিয় পদার্থের ক্ষমতার উৎস এবং নিউক্লিয় ক্ষমতা (বিদ্যুৎ) উৎপাদনের ভিত্তি।
আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে দুটি বল সবসময়ই অনুভব করে থাকি। একটি হচ্ছে অভিকর্ষ বল—ভূপৃষ্ঠে বা তার নিকটে সকল বস্তুর ওপর পৃথিবীর আকর্ষণ বল। অপরটি হচ্ছে ঘর্ষণ বল— কোনো তলের ওপর দিয়ে অপর তলের চলাচলের সময় যে বল উৎপন্ন হয়। এ ছাড়াও আমরা অন্য যে সকল বলের সাক্ষাৎ পাই সেগুলো হলো কোনো বিকৃত স্প্রিং-এর পুনরানয়ন বল, দুটি আহিত বস্তুর মধ্যকার স্থির তড়িৎ বল এবং একটি চুম্বক ও লোহার টুকরার মধ্যকার চৌম্বক বল। পরমাণু ও নিউক্লিয়াসের সূক্ষ্ম জগতেও বল ক্রিয়া করে। যেমন, পরমাণুর অভ্যন্তরে পারমাণবিক বলসমূহ পরমাণুর উপাদানসমূহকে একত্রে রাখে। নিউক্লিয় বল নিউক্লিয়াসের বিভিন্ন অংশে ক্রিয়া করে এই অংশগুলোকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। এ সকল বল জটিল দেখালেও প্রকৃতিতে কেবল চারটি মৌলিক বল এবং তাদের মধ্যকার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া বা মিথস্ক্রিয়া (interaction) বিদ্যমান।
মহাবিশ্বের যে কোনো দুটি বস্তুর মধ্যকার পারস্পরিক আকর্ষণ বলকে মহাকর্ষ বল বলে। কোনো বস্তুর ওজন হচ্ছে মহাকর্ষ বলের ফলশ্রুতি। যদিও স্থূল বস্তুগুলোর মধ্যকার মহাকর্ষ বল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে, কিন্তু চারটি মৌলিক বলের মধ্যে মহাকর্ষ বল হচ্ছে দুর্বলতম বল। অবশ্য এই কথাটি প্রযোজ্য হয় মৌলিক কণাগুলোর পারস্পরিক বল বিবেচনা করে তাদের আপেক্ষিক সবলতার বিচারে। যেমন, কোনো হাইড্রোজেন পরমাণুতে ইলেকট্রন ও প্রোটনের মধ্যকার মহাকর্ষ বল হচ্ছে 3-6 x 10-47 N; অপরপক্ষে এই কণা দুটির মধ্যকার স্থির তড়িৎ বল হচ্ছে 8 2 × 10-8 N । এখানে আমরা দেখি যে, স্থির তড়িৎ বলের তুলনায় মহাকর্ষ বল তাৎপর্যপূর্ণ নয়।
দুটি আহিত কণা তাদের আধানের কারণে একে অপরের ওপর যে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল প্রয়োগ করে তাকে তাড়িতচৌম্বক বল বলে। তড়িৎ বল এবং চৌম্বক বল ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। যখন দুটি আহিত কণা স্থির থাকে তখন তাদের ওপর কেবল তড়িৎ বল ক্রিয়া করে। যখন আহিত কণাগুলো গতিশীল থাকে তখনকার একটি অতিরিক্ত তড়িৎ বল হচ্ছে চৌম্বক বল। যদিও দুটি আহিত মৌলিক কণার মধ্যকার তড়িৎ বল মহাকর্ষ বলের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী, তবুও সবলতার বিচারে তড়িৎ বল হচ্ছে মাঝারি ধরনের। লক্ষণীয় যে, আমাদের এই স্কুল জগতের যাবতীয় বলসমূহ (মহাকর্ষ বল ব্যতীত) তড়িৎ বলেরই বহিঃপ্রকাশ। ঘর্ষণ বল, স্পর্শ বল, স্প্রিং বা অন্যান্য বিকৃত বস্তুর মধ্যকার বল আহিত কণাগুলোর তড়িৎ বলেরই ফলশ্রুতি
পরমাণুর নিউক্লিয়াসে নিউক্লিয় উপাদান তথা নিউক্লিয়নগুলোকে একত্রে আবদ্ধ রাখে যে শক্তিশালী বল তাকে সবল নিউক্লিয় বল বলে। নিউক্লিয়াসের স্থায়িত্বের জন্য অবদান রাখে যে বল তা হলো সবল নিউক্লিয় বল। এই বলই নিউক্লিয়নগুলোকে একত্রে রাখার জন্য আঠার মতো কাজ করে। সবগুলো মৌলিক বলের মধ্যে এই বলই সবচেয়ে শক্তিশালী। এর পাল্লা 10-15 m. যা একটি নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধের সমান। দূরত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে সবল নিউক্লিয় বল হ্রাস পায় এবং 10-14m এর বেশি দূরত্বে এ বল উপেক্ষণীয় ।
এই বল কয়েকটি নিউক্লিয় বিক্রিয়ার জন্য দায়ী। এই বল অনেক নিউক্লিয়াসে অস্থিতিশীলতার উদ্ভব ঘটায়। অধিকাংশ তেজস্ক্রিয় ভাঙন বিক্রিয়াগুলো দুর্বল নিউক্লিয় বলের কারণে ঘটে থাকে।
মৌলিক বলগুলোর তুলনা করা যাক। প্রত্যেকটি বলের পাল্লা তথা যে দূরত্ব পর্যন্ত বলগুলো ক্রিয়া করে তা বিবেচনা করা যাক। মহাকর্ষ বল এবং তাড়িতচৌম্বক বল হচ্ছে বিপরীতবর্গীয় বল। দূরত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে এই বলগুলোর মান হ্রাস পায়, কিন্তু কখনো শূন্য হয় না। এই দুই বলের পাল্লা হচ্ছে অসীম। সবল নিউক্লিয় বলের পাল্লা খুবই কম; 10-15m-এর বেশি দূরত্বে এই বল অনুভূত হয় না। দুর্বল নিউক্লিয় বলের পাল্লা আরো কম, 10-16m এরও কম।
বলের পাল্লার মধ্যে অবস্থিত মৌলিক কণাগুলোর মধ্যকার বলের মান দ্বারা একটি বলের আপেক্ষিক সফলতা বিচার করা হয়। সবলতার একটি স্কেলে যদি মহাকর্ষ বলের সূচক 1 হয়, তাহলে দুর্বল নিউক্লিয় বলের সূচক 1030, তাড়িতচৌম্বক বলের সূচক 1039 এবং সবল নিউক্লিয় বলের সূচক 1041 হয় ।
মহাকাশ ভ্রমণে আপেক্ষিকতা তত্ত্বের যে বিষয়টি প্রাসঙ্গিক তা হলো কাল দীর্ঘায়ন। আমরা জানি যে, পৃথিবী থেকে কোনো ব্যক্তি মহাকাশ ভ্রমণে গেলে পৃথিবীর কোনো পর্যবেক্ষকের নিকট মহাকাশচারীর ঘড়ি, পৃথিবীতে অবস্থানকারী কোনো ব্যক্তির অভিন্ন ঘড়ির চেয়ে ধীরে চলে । অর্থাৎ কম সময় দেয়। মহাকাশ ভ্রমণে এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হয় । এ প্রসঙ্গে আমরা যমজ কূটাভাসের (Twin paradox) কথা বলতে পারি। কূটাভাস হলো এমন ঘটনা যা আপাত দৃষ্টিতে সত্য মনে না হলেও আসলে সত্য।
যমজ কূটাভাস : কাল দীর্ঘায়নের একটি মজার ফলাফল বা পরিণতি হলো যমজ কুটাভাস। ২০ বছর বয়সী দুই যমজ ভাই সাদিক ও ইকবালকে নিয়ে একটি নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষণ বিবেচনা করা যাক। সাদিক ভ্রমণবিলাসী সে পৃথিবী | থেকে ৩০ আলোক বর্ষ দূরে একটি গ্রহে যেতে পৃথিবী থেকে রওনা হলো। তার মহাশূন্য যান প্রায় আলোর সমান দ্রুতিতে যেতে সক্ষম। গ্রহে পৌঁছার পর সাদিকের মন বাড়ির জন্য আনচান করতে লাগল। তাই সে একই দ্রুতিতে (আলোর কাছাকাছি দ্রুতিতে) পৃথিবীতে ফিরে এলো। পৃথিবীতে ফিরে সে দেখে অবাক হলো যে, পৃথিবীর অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। সাদিকের যমজ ভাই ইকবালের বয়স প্রায় ৮০ বছর। আর সাদিকের বয়স তার চেয়ে কম হয়েছে প্রায় ১০ বছর। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে কোন যমজ ভাই (সাদিক না ইকবাল) একে অপরের তুলনায় আলোর কাছাকাছি দ্রুতিতে ভ্রমণ করেছে, সুতরাং কার বয়স বাড়েনি। এখানেই রয়েছে কূটাভাস (paradox) | ইকবালের প্রসঙ্গ কাঠামোর সাপেক্ষে ইকবাল নিশ্চল কিন্তু সাদিক অত্যন্ত বেশি বেগ নিয়ে ভ্রমণ করেছে। সাদিকের মতে, যদিও ইকবাল পৃথিবীতে সাদিকের সাপেক্ষে দূরে চলে যাচ্ছে এবং পরে ফিরে আসছে। এটাই হলো অসঙ্গতি যে আমাদের উপরোক্ত ভবিষ্যদ্বাণী বা ধারণায় কোনো যমজ ভাই প্রকৃতপক্ষে বেশি বয়স্ক । |
---|
এই কূটাভাসের সমাধানের জন্য এটা মনে রাখতে হবে যে আমরা ভ্রমণকে যতোটা প্রতিসম মনে করছি আসলে তা নয়। মহাশূন্যচারী সাদিক তার ভ্রমণকালে ভিন্ন গ্রহে গমন ও পৃথিবীতে ফিরে আসতে একরাশ ত্বরণ ও মন্দনের অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছে। সুতরাং সে তার ভ্রমণকালের একটি বৃহৎ অংশে জড় প্রসঙ্গ কাঠমোতে ছিল না। সুতরাং এই প্রসঙ্গ কাঠামোতে আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের ভিত্তিতে করা ভবিষ্যদ্বাণী খাটে না। অপরপক্ষে ইকবাল সকল সময়েই তার জড় প্রসঙ্গ কাঠামোতে রয়েছে, সুতরাং তার বেলায় আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের ভিত্তিতে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব। সুতরাং মহাশূন্যচারী সাদিককে পৃথিবীতে ফিরে আসার পর অল্প বয়সী মনে হবে। মহাকাশ ভ্রমণের সময় মহাশূন্যচারীকে কাল দীর্ঘায়নের ব্যাপারটি বিবেচনায় রাখতে হবে। কাল দীর্ঘায়নের কারণে অতিদ্রুতগামী মহাশূন্য যানের আরোহী তার বয়স খুব কম থেকে যাবে। এর কারণ হলো মহাশূন্যযানের ঘড়ি, পৃথিবীতে থাকা পর্যবেক্ষকের ঘড়ির চেয়ে ধীরে চলবে । মূলত কম সময় অতিবাহিত হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, এক বছর ভ্রমণকাল পৃথিবীর ১০ বছরের সমান হতে পারে । পৃথিবীর ঘড়ির সময় অনুসারে কোনো মহাশূন্যযানে যাত্রী কোটি কোটি বছর পরেও পৃথিবীতে ফিরতে পারে। বাস্তব সমস্যার উপর ভিত্তি করে বর্তমান মহাশূন্য উড্ডয়ন প্রযুক্তিতে একটা তাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ মহাশূন্য যানের দ্রুতি আলোর কাছাকাছি পৌঁছাতে হলে এর প্রচলনের ( propulsion) জন্য যে শক্তির প্রয়োজন তার সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
এছাড়া মহাশূন্য ভ্রমণে অত্যধিক দ্রুতিতে (আলোর কাছাকাছি দ্রুতিতে) স্থান সংকোচনের ব্যাপারটি মাথায় রাখতে হবে। মহাশূন্যচারীর দিকে অগ্রসর হওয়া কোনো যানকে স্থান সংকোচনের কারণে ছোট মনে হবে, অপর মহাশূন্যচারীও তাই দেখবেন। এছাড়া কোনো মহাশূন্যযান পৃথিবীতে ফেরার সময় পৃথিবীর পর্যবেক্ষক একে সে উচ্চতায় দেখবেন, মহাশূন্যচারী তার চেয়ে কম উচ্চতায় দেখবেন।
আরও দেখুন...